শাকুর মাহমুদ চৌধুরী, উখিয়া (কক্সবাজার)।।
কক্সবাজারের উখিয়া হাই স্কুল মাঠে শুরু হওয়া মাসব্যাপী কুটির শিল্প ও বাণিজ্য মেলা সাফল্যের সাথে চলমান। এটি শুধু স্থানীয়দের জন্য নয়, উখিয়া ও কক্সবাজার জেলার অন্যান্য এলাকার মানুষ এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের জন্যও এক বিশেষ আনন্দের উৎস হয়ে উঠেছে। যেখানে গ্রাম্য মানুষ এবং রোহিঙ্গাদের জন্য বিনোদনের তেমন কোনো সুযোগ ছিল না, সেখানে এই মেলা এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। মেলার মধ্য দিয়ে সেখানে আনন্দ, সংস্কৃতি, বিনোদন এবং ব্যবসার সমন্বয়ে স্থানীয় জনগণ এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি মেলবন্ধন সৃষ্টি হচ্ছে।
কক্সবাজারের উখিয়া হাই স্কুল মাঠে মেলার আয়োজন স্থানীয়দের জন্য প্রথমে একটি আকর্ষণীয় সুযোগ হলেও, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হাজার হাজার বাসিন্দা প্রতিদিন মেলায় আসছেন, তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে। মেলাটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, এটি রোহিঙ্গাদের জন্য বিনোদনের এক অনন্য সুযোগ হিসেবে কাজ করছে। যেখানে রোহিঙ্গারা তাদের ক্যাম্পে ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছিল, সেখানে এই মেলার মাধ্যমে তারা কিছুটা হলেও স্বাভাবিক জীবনের অনুভূতি পাচ্ছেন।
রোহিঙ্গা তরুণ ইয়াছিন জানান, “আমাদের ক্যাম্পে বিনোদনের কোনো সুযোগ নেই, তাই বন্ধুকে নিয়ে মেলায় এসেছি। মেলা হওয়াতে আমাদের জন্যও কিছুটা আনন্দের মুহূর্ত মিলেছে।” তার বন্ধু কাদের হোসেনও বলেন, আমরা সাধারণত ক্যাম্পের মধ্যে খেলা বা মেলা হলে সেখানেই চলে যাই, যাতে একটু আনন্দ পেতে পারি।
এ বছরের মেলা আগের সব মেলার চেয়ে অনেক বড় এবং সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। মেলাপ্রাঙ্গণে বিভিন্ন ধরনের কুটির শিল্প, দেশীয় ও বিদেশী পণ্যের স্টল রয়েছে। ক্রেতাদের ভিড়ে যেন এক বিশাল বাজারের অবস্থা, এবং স্টলগুলোতে ক্রেতাদের চাহিদার কোনো কমতি নেই। বিশেষ করে স্থানীয় এনজিও কর্মীরা ক্যাম্পে কাজ শেষে মেলায় এসে শপিং করছেন বা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন। এমনকি, কিছু এনজিও কর্মী ও স্থানীয় ব্যবসায়ী মেলার বিভিন্ন পণ্যের প্রচারণা করছেন।
উখিয়ার কণ্যা কামরুল তানিয়া, একজন মেলা পরিদর্শক বলেন, বিকেল বেলা যখন এনজিওকর্মীরা ক্যাম্পের কাজ শেষ করে, তখন তারা মেলায় আসেন। বিশেষ করে ছুটির দিনে পরিবার নিয়ে এসে তারা আনন্দ নিয়ে ফিরে যান। এটি শুধু আনন্দের উৎস নয়, অনেকটা তাদের জীবনের এক রিফ্রেশ হওয়ার জায়গাও।
এছাড়া, মেলার একটি বিশেষ আকর্ষণ হল “জুলাই কর্ণার”, যেখানে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। এই কর্ণারটি বিশেষভাবে রোহিঙ্গাদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে, কারণ এটি তাদের স্বজনদের হারানো, সংগ্রামের ইতিহাসের একটি বড় অংশের স্মৃতি ধরে রাখছে।
উপজেলা প্রেসক্লাব উখিয়া’র সভাপতি এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, এখানে ‘জুলাই কর্ণার’ আমাকে আমার সন্তান আবু সাঈদ ও মুগ্ধদের হারানোর স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে। এটি আমার জন্য অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। মেলার এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।
উখিয়া ও কক্সবাজার অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ মেলায় আসছেন। মেলাপ্রাঙ্গণ প্রতিদিনই জনাকীর্ণ হয়ে উঠছে, বিশেষ করে ছুটির দিনে। কেউ কেউ প্রিয়জনকে নিয়ে মেলায় আসেন, আবার অনেকেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সেলফি তুলছেন, পণ্য কিনছেন, এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশ উপভোগ করছেন। স্থানীয় সাঈদুল বশর, যিনি নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে এসেছেন, জানান, আজ আমি প্রথমবার কক্সবাজার বাণিজ্য মেলায় আসলাম। এতদিন সময় না পেয়ে মেলা দেখতে আসা হয়নি, কিন্তু আজকের দিনটা খুবই বিশেষ।
উখিয়া প্রেসক্লাবের সাবেক সহ সভাপতি সাংবাদিক হুমায়ুন কবির জুসান মেলার ভবিষ্যত সম্পর্কে আশাবাদী। তিনি বলেন, মেলা এই মুহূর্তে জমে উঠেছে এবং আমি বিশ্বাস করি যে সামনে আরো জমে উঠবে। এলাকার মানুষ এবং রোহিঙ্গাদের জন্য এটি একটি বড় সুযোগ হয়ে উঠবে।
এছাড়া, এই মেলার মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতি কিছুটা হলেও চাঙ্গা হচ্ছে। ক্রেতারা শুধু মেলার পণ্য নয়, এখানকার স্থানীয় কুটির শিল্প এবং ছোট ব্যবসাগুলিও সমর্থন করছেন।
এটি শুধু কক্সবাজার বা উখিয়ার সাধারণ মেলা নয়, এটি হয়ে উঠেছে একটি মঞ্চ যেখানে স্থানীয় এবং রোহিঙ্গা জনগণের জন্য বিনোদন, ব্যবসা, এবং সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটছে। এখানকার মেলা তাদের জীবনে কিছুটা আনন্দ ও আশার আলো ফিরিয়ে দিয়েছে। ভবিষ্যতে, এটি আরও বড় আকারে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে, যেখানে স্থানীয় জনগণ ও শরণার্থীদের পাশাপাশি অনেকে একত্রে আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারবেন।